ঢাকায় আসছি দশ বছরের-ও বেশি সময় আগে, একটু অদ্ভূত শুনাইলেও একটা সত্য ব্যাপার হইলো এই দশ বছরে ঢাকার অনেক জায়গাতেই পা ফেলা হয় নাই। বেইলি রোড, গুলশান, খিলগাঁও অন্যতম কিছু নাম। সৌভাগ্যবশত এই তালিকা থাইকা পুরান ঢাকার নামটা মুছে ফেলার সুযোগ ঘটছিলো কিছুদিন আগে। আরো নির্দিষ্ট কইরা বললে ২০২১ এর ২৫শে ডিসেম্বরে।
পুরান ঢাকা নিয়া বিশেষ রকমের কৌতুহল সবার মধ্যেই লক্ষ্য করছি। বাচ্চাকালে বিটিভিতে ’বিশ্বাস’ দেখে দেখে আমার মধ্যেও সেই কৌতুহল বাসা বাঁধছিলো। পুরান ঢাকা মানে শুরুতেই বিরিয়ানি এরপর চিপা গলি, শ’খানেক বছরের পুরান বিল্ডিং, লালবাগ, বাকর খানি, লাচ্ছি আর কী কী আছে সেই লিস্ট আমার কাছেও নাই। তো সেই পুরান ঢাকায় আমার পদার্পন হইছিলো হুট কইরা।
জাহিদের হঠাৎ ফোনকলে ইনভাইটেশন পাইছিলাম পুরান ঢাকা ঘুরার। ঘুরার নিয়ত আরও চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই ছিলো তবে ২৫ তারিখে যাওয়ার ব্যাপারে আমার সামান্য আপত্তি শুরুতে থাকলেও, পরে ‘যা আছে কপালে’ ভাব নিয়ে রাজি হয়ে গেছি। কপাল ভালোই ছিলো বলতে হবে।
স্ট্রেইট টু লালবাগ
আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিলো লালবাগ। এই ডে-আউট অন্যান্যগুলার থেকে একটু ভিন্ন ছিলো, কারণ যে চারজন গেছিলাম তাদের মধ্যে দুইজনের সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিলোই না। সেই দুইজনের একজন হইলো তাসনিম এবং আরেকজন বাধন ভাই। তাসনিম আমাদের পিকআপ করছিলো ফার্মগেট থেকে। গাড়িতে চেপে বসার পর চললো ফার্মগেট থেকে শাহবাগ এরপর টিএসসি, ঢাবির এরিয়া হয়ে লালবাগের উদ্দেশ্যে।
ক্রিসমাসের দিন হওয়ার কারণেই সম্ভবত অন্যান্য দিনের তুলনায় ট্রাফিক তুলনামূলক কম ছিলো সেদিন। ঘন্টাখানেকের ভেতরেই সরু রাস্তা দিয়ে তৎকালীন লালবাগের কেল্লার মূল ফটকের সামনে হাজির হইলাম, কনস্ট্রাকশনের কাজ চলায় ঐদিক দিয়ে সুবিধা করতে না পেরে ভিন্ন রাস্তা দিয়ে যাওয়া লাগছিলো। কেল্লার আশেপাশের এরিয়া যতটা জমকালো ভাবছিলাম আদতে সেরকম কিছুই না, পুরান ঢাকার আর দশটা জায়গার মতই কেল্লার চারিদিকে সরু রাস্তা, মানুষ আর গাড়ি-ঘোড়া দিয়ে ভরা। তবে কেল্লার সামনে বেশ কিছু ভালো রেস্টুরেন্ট আর জুস বার আছে।
আমরা যখন পৌঁছাইছি তখন প্রায় দুপুরের কাছাকাছি সময়, সকালে সামান্য শীত থাকলেও ততক্ষণে রোদের কারণে আবহাওয়া গরম হওয়া শুরু হইছে। যাই হোক, চারজনে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম কেল্লায়। প্রথম নজরেই জায়গাটা আমার ভালো লেগে গেছে, লালবাগের কিছু ড্রোন শট দেখছিলাম অনেকদিন আগে তখনও ভালো লাগছিলো। যদিও খুব বেশি জিনিসপাতি নাই ভেতরে তবুও সব মিলায়া পরিবেশটা চমৎকার। পুরান দেয়াল, পুরান ইট দেখে আমি এতটাই ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম যে বারবার শুধু ছুঁয়ে দেখতেছিলাম ওগুলাকে।
লালবাগের কেল্লায় কী কী আছে?
মোটামুটি রকমের গাছপালা আর ফুলের বাগান।
একটা মসজিদ, কিছু বাধাই করা কবর।
পরিবিবির মাজার আর দূর্গের ধ্বংসাবশেষ। পরিবিবির মাজারে ছোটখাটো জাদুঘর আছে, তবে আমাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয় নাই।
ছোট্ট ছোট্ট কিছু টিলা আর বিশাল ভাঙা দেয়াল।
শুকায় যাওয়া পুকুর, যেটারে পুকুর কম অ্যাম্ফিথিয়েটার বেশি মনে হয়।
মোটামুটি এই হইলো সংক্ষেপে লালবাগে উপস্থিত জিনিসপাতির তালিকা। আরও অনেক টুকটাক জিনিস আছে, তবে বড় আকারে এইসবই।
আর্মেনিয়ান চার্চ
লালবাগের কেল্লা থেকে আমরা আর্মেনিয়ান চার্চের দিকে হাঁটা ধরলাম। ওখান থেকে হেঁটে যাইতে প্রায় আধ ঘন্টা লাগে। ক্রিসমাসের দিন হওয়ায় চার্চ সবার জন্যে উন্মুক্ত ছিলো, অন্যান্য সময় তেমনটা থাকে কিনা সেটা জানা নাই। চার্চ নিয়ে আমার ফ্যাসিনেশন ছিলো অনেক আগে থেকেই, বাসার কাছেই একটা চার্চ আছে তবে সেখানে সবার জন্যে প্রবেশাধিকার খুব সম্ভবত নাই তাই যাওয়াও হয় নাই। আর্মেনিয়ান চার্চ ছোট্ট জায়গা জুড়ে হইলেও জায়গাটা ঐতিহাসিক এবং যথেষ্ট সুন্দর। চার্চে প্রবেশের সময় রেজিস্টারে নাম এন্ট্রি করতে হয়, তখন আমাদের জানায় দেয়া হইলো কবরের ছবিগুলা বাদে আমরা যেকোনো কিছুর ছবি তুলতে পারবো। কারণটা সম্ভবত ধর্মীয়, আমার সঠিক জানা নাই। জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো কিন্তু চার্চ দেখার আগ্রহের চোটে সেই প্রশ্ন করা হয়ে উঠে নাই।
চার্চের শুরুটাই হইছে আশেপাশে ছড়ায় ছিটায় থাকা কবর দিয়ে, মুভি সিরিজে যে গ্রেভইয়ার্ডগুলা দেখছি সেগুলা সাধারণত সমান্তরালে সার সার করে থাকে। এখানে দেখলাম নির্দিষ্ট করে সেরকম কোনো প্যাটার্ন মানা হয় নাই, তাছাড়া সবথেকে নতুন যে কবরটা আমার চোখে পড়ছে সেটাও আজ থেকে ১৭ বছর আগেকার। বেশিরভাগ কবরগুলাই মূলত ১৯ শতকের, অল্প কয়েকটা বাদে বাকিগুলায় গ্রেভস্টোন নাই। এপিটাফগুলা মূলত ইংলিশে লেখা, কিছু কিছু ল্যাটিন-ও আছে। সবথেকে বেশি নজর কাড়ছে চ্যাপেলের প্রবেশপথে থাকা একটা কবরের এপিটাফ, সবথেকে লাক্সারিয়াস আর সুন্দর এপিটাফ ছিলো সেটা। ঐ এপিটাফ থেকে সামান্য দূরেই একটা ভাঙা মূর্তি আছে।
চার্চটা আকারে ছোট হইলেও স্যাংকচুয়ারি দেখলে সেটা তেমন অনুভূত হয় না, কারণ হইলো ভেতরের উচ্চতা। অল্টার বাদে অন্যান্য অংশ খুব একটা জাকজমকপূর্ণ না। অল্টারের সামনেই ক্রুসিফাইড পেইনটিং রাখা। চার্চে খুব বেশি মানুষ ছিলো না, আমরা কিছুক্ষণের জন্যে চেয়ারে বসে চার্চটা দেখতেছিলাম। একটা সরু সিড়ি খেয়াল করলাম উপরে ওঠার জন্যে, সিড়ির ব্যাপারে জানতে চাইলে বলা হইলো ওখানে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধীকার এখন নাই, উপর থেকে ঘন্টা সরাসরি দেখার সুযোগ আছে বাইরে থেকে যেটা সামান্য দেখা যায়। ১৭৮১ সালের এই চার্চে আমরা ছিলাম ২০ মিনিটের মতন।
কাচ্চিইইই!
পুরান ঢাকা গিয়া বিরিয়ানী খাবো না সেরকম প্লান নিয়া তো বের হই নাই। আমার নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ ছিলো না অবশ্য, যে কোনো একটা জায়গায় গিয়ে খাইলেই হইলো। খুঁজতে খুঁজতে একসময় গিয়ে ঢুকলাম গ্র্যান্ড নওয়াবে। পুরান ঢাকার রাস্তাঘাটের মতন গ্রান্ড নওয়াব-ও ছোটখাট। তাদের মাটন কাচ্চি আমার কাছে আহামরি কিছু মনে হয় নাই, কাচ্চির আলুর যে মর্যাদাটুকু প্রাপ্য সেটা তারা দিতে পারে নাই। তবে তাদের কাবাবটা ছিলো মারাত্মক।
কাচ্চির পাশাপাশি বিউটি লাচ্ছি খুঁজে সেখান থেকে লাচ্ছিও খাওয়া হইলো। জায়গাটা খুব একটা হাইজেনিক না আবার একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হইলো লাচ্ছি পার্সেল করে দিতে বলায় তারা পলিথিনে করা দিতে চাচ্ছিলো। স্বভাবতই সেটায় রাজি হওয়ার কারণ ছিলো না, তাই সেখান থেকে খেয়ে বের হইলাম।
খাওয়া দাওয়ার ভেতরে আমি এর বেশি কিছুতে আর যাই নাই, তবে বাকিদের মধ্যে তাসনিম ‘আগুন পান’ নামক এক বিশেষ বস্তু ট্রাই করছে। যেটা লিট্রেলি আগুনের সাথে খাওয়া হয়!
বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট
খাওয়া দাওয়ার পর আহসান মঞ্জিল ঘুরার শখ ছিলো। কিন্তু সেখানে পড়া গেলো ফ্যাসাদে, অনলাইন টিকেট কেটে ঢুকা লাগবে কিন্তু ঐ তারিখের টিকিটের অপশন নাই, শেষমেশ গেটের সামনে থেকে ফিরতে হইলো। পাশেই সদরঘাট থাকায়, সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হইলো। TBH, that was a good decision! বুড়িগঙ্গার কালো ময়লা পানি একটু মন খারাপ করানো বাদে এঞ্জয়মেন্টে বিশেষ প্রভাব ফেলে নাই। র্যান্ডম একটা লঞ্চের একদম ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছিলাম, ছাদে বেশ কিছুক্ষণ লম্ফঝম্ফ করে দেখতে গেছিলাম সুরভী-৭। যেটা নাকি সবথেকে বড় লঞ্চ। টিকেট সেলার যেমনে কনভিন্স করছিলো সুরভী-৭ দেখার জন্যে, যেন না দেখলে জীবন বৃথা। অথচ আহামরি কিছুই ছিলো না, ছাদেও ওঠা সম্ভব হয় নাই।
ব্যাক টু বাসা
পুরান ঢাকা জার্নির ইতি এখানেই। ততক্ষণে বিকাল গড়ায় গেছে। যতটা এক্সপেক্ট করছিলাম তার থেকে অনেকটা বেশি উপভোগ করছি। চকবাজারের মারাত্মক ট্রাফিক, পলেস্তারা খসা পুরান বিল্ডিং, লঞ্চঘাটে মানুষের চিল্লাফাল্লা এই সবকিছু নিয়ে ভাবলে রোমান্টিসিজম কাজ করে। স্থানীয় বাসিন্দা হইলে সেটা কতটুকু কাজ করতো সেটা ভাববার মতন বিষয়।